দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে চিন্তা
দ্বিতীয় বিয়ে কিঃ
বিয়ে সবাই জীবনে একবারই করতে চায়।তবে সময় বা পরিস্থিতি সব সময় অনুকুলে থাকে না তাই তো ডিভোর্স বা স্বামী/ স্ত্রী বিয়োগের মত ঘটনাও ঘটে।আর তার পরই আসে দ্বিতীয় বিয়ের প্রসঙ্গ ।
আমাদের সমাজে একের বেশি বিয়ে প্রচলিত রয়েছে। তবে ইদানিংকালে এই দ্বিতীয় বিয়ে যেন এক নিয়ম হয়ে গেছে।দেশে যেমন বেড়েছে ডিভোর্সের হার তেমনি দ্বিতীয় বিয়ের সংখ্যাও কম নয়।
কেন এই দ্বিতীয় বিয়েঃ
সংসার নানা কারনে ভেঙ্গে যেতে পারে, তবে আমাদের সমাজে একটি ছেলের ডিভোর্স সমাজ যত সহজে মেনে নেয় ।ডিভোর্সি একটি মেয়েকে ততটা সহজ ভাবে মেনে নেওয়া হয়না । বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মেয়েটিকেই সবকিছুর জন্য দায়ী করা হয়।
তবে বাস্তবতা হল জীবনের সব ক্ষেত্রে সব কিছু আমাদের মনের মত্ন হয় না ।কখনো কখনো মানিয়ে ও নিতে হয় দিতে হয় ছাড় ।কিন্তু এভাবে ছাড় দিতে দিতে আর মানিয়ে নিতে গিয়ে যখন নিজের অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় দেখা দেয় যখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যায় ঠিক সেই মুহূর্তেই আসে ভাঙ্গনের ঢেউ । দুটি মানুষের দুটি পথ হয় আলাদা।
তবে পরিবার কাউকে একাকী জীবন পার করতে দেয় না,তবে অনেকে নিজ উদ্যোগেও পুনরায় সঙ্গী খুঁজে নেয়।
একথাও ঠিক একাকী জীবন পার করা খুব কঠিন।তবে একথাও ঠিক এমন অনেকেই আছেন যারা সারা জীবন একাই কাটিয়ে দেন।কিন্তু একাকী সেই জীবনে থাকে না রঙ। কেউ কেউ আবার এক বার ঘর ভাঙ্গার পর আর ঘর বাঁধতে চান না পাছে আবার এক ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়…।
এমন ধারনা থেকে আমাদের বেড়িয়ে আসা উচিৎ কারন জীবনে আপনার সব সিধান্ত যে ভুল হবে তেমন না। হয়ত আপনার জন্য যিনি সঠিক তার সাথে দেখা হয় নি সঠিক মানুষটি হয়ত আছে আপনারই অপেক্ষায়।
পুরুষের ২য় বিয়ের ক্ষেত্রে করণীয়ঃ
বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী,একজন পুরুষ একের অধিক বিয়ে করতে পারবে তবে সে ক্ষেত্রে অবশ্যই বর্তমান স্ত্রীর অনুমতি নিতে হবে।অর্থাৎ কোনো ব্যক্তির স্ত্রী বর্তমান থাকাকালে আরেকটি বিয়ে করতে চাইলে , তাকে তার বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের মধ্যে সর্বশেষ স্ত্রীর এলাকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে আরেকটি বিয়ে করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করতে হবে।বিয়ের অনুমতি পেলে তবে সে বিয়ে করতে পারবে।
মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ ১৯৬১-এর ৬ ধারা অনুযায়ী, দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে সালিসি পরিষদের কাছে অনুমতি না নিয়ে বিয়ে করলে সেই বিয়ে নিবন্ধন হবে না।এবং উক্ত অনুমতি পাবার জন্য নির্ধারিত ফি জমা দিয়ে চেয়ারম্যানের কাছে আবেদন করতে হবে। এ আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বিয়ের অনুমতি দিতে কিছু বিষয় বিবেচনায় রাখা হবে।
যেসব বিষয় বিবেচনায় রাখা হবেঃ
১. বর্তমান স্ত্রীর বন্ধ্যাত্ব
২.মারাত্মক শারীরিক দুর্বলতা
৩.দাম্পত্যজীবন সম্পর্কিত শারীরিক অযোগ্যতা
৪.দাম্পত্য অধিকার পুনর্বহালের জন্য আদালত থেকে প্রদত্ত কোনো আদেশ বা ডিক্রি বর্জন ও
৫. মানসিকভাবে অসুস্থতা ইত্যাদি।
আর কোনো পুরুষ যদি সালিসি পরিষদের অনুমতি ছাড়া দ্বিতীয় বিয়ে করেন, তবে তিনি অবিলম্বে তাঁর বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীদের পাওনা দেনমোহরের সম্পূর্ণ টাকা সাথে সাথে পরিশোধ করতে হবে।এই পর্যায়ে বর্তমান স্ত্রী বা স্ত্রীরা আদালতে মামলার মাধ্যমে বিবাহবিচ্ছেদের সম্পূর্ণ অধিকার পাবেন ।আর দ্বিতীয় বিয়ে করার কারণে প্রথম স্ত্রী যদি তার স্বামীর থেকে আলাদা বসবাস করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেন তবে সে৩ ক্ষেত্রেও তিনি স্বামীর কাছ থেকে ভরণপোষণ পাবেন। এ ক্ষেত্রে নাবালক সন্তানদের ভরণপোষণও তাদের বাবাকেই দিতে হবে ।শুধু তাই নয় ভরণপোষণের পাশাপাশি স্ত্রী ও সন্তানদের উত্তরাধিকারীর অধিকারও বজায় থাকবে কোনো অবস্থাতেই সে অধিকার খর্ব হবে না। এ ছাড়া ২য় বিয়ের ক্ষেত্রে স্বামীর অনুমতি না নেওয়ার বিষয়টি প্রমানিত হলে এই অভিযোগে স্বামী দোষী সাব্যস্ত হলে সাত বছর পর্যন্ত জেল ও ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড কিংবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন। সেই সাথে ২য় বিয়ে অবৈধ বলে গণ্য হবে।
নারীর দ্বিতীয় বিয়ের ক্ষেত্রে করনীয়ঃ
বাংলাদেশের মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৬১ অনুযায়ী, ১ম স্বামীর সঙ্গে দাম্পত্য সম্পর্ক বিদ্যমান থাকা অবস্থায় স্ত্রী যদি আবারও বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন, তাহলে সেই দ্বিতীয় বিয়ে আইনত অবৈধ, অকার্যকর ও বাতিল হিসেবে গণ্য হবে।যদি কোন স্ত্রী দ্বিতীয় বিয়ে করতে চায় তাহলে তাঁকে অবশ্যই প্রথম স্বামীর সঙ্গে যথাযথ আইন মেনে বিবাহবিচ্ছেদ করে নিতে হবে। স্ত্রী ১৯৬১ সালের মুসলিম পারিবারিক আইন অধ্যাদেশ অনুসারে,স্ত্রী তার প্রথম স্বামীকে তালাকের উদ্দেশ্য পর পর ৩ বার ইউনিয়ন পরিষদ/ জেলা/ সিটি কর্পোরেশনের চেয়ারম্যন/কাউন্সিলর / কমিশনার এর কার্যালয়ে নোটিশ প্রদান করবেন।স্ত্রী কর্তৃক এই নোটিশ প্রদানপূর্বক ৯০ দিন ইদ্দত পালন শেষে তালাক কার্যকর হয়।পর পর এই তিনটি নোটিশ দেবার পর স্বামী যদি তালাক নামায় সাক্ষর নাও করেন তার পরও তালাক কার্যকর হবে। আর এর পর ই একজন স্ত্রী এই আইনগত বিধান মেনে দ্বিতীয় স্বামী গ্রহণ করতে পারে ।
যদি কেউ এই বিধান লঙ্ঘন করে প্রথম স্বামীর সঙ্গে বিয়ে বলবৎ থাকা অবস্থায় অন্য কাউকে বিয়ে করেন, সে ক্ষেত্রে প্রথম স্বামী তার স্ত্রীর বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা করতে পারবেন। সে ক্ষেত্রে স্ত্রী ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারা অনুযায়ী সর্বোচ্চ সাত বছর পর্যন্ত কারাদণ্ডে দন্ডিত হতে পারেন। সেই সঙ্গে আর্থিক জরিমানাও হতে পারে ।
তবে স্ত্রী যদি তাঁর ১ম স্বামীর থেকে বিচ্ছিন্ন থাকেন যোগাযোগ না থাকে অর্থাৎ স্বামীর যদি সাত বছর যাবৎ কোনো খোঁজখবর না থাকে, অথবা তিনি জীবিত থাকতে পারেন—এমন কোনো তথ্য জানা না যায়, তাহলে পরবর্তী স্বামীকে সকল সত্যি ঘটনা জানিয়ে তাঁর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারেন। এটি দণ্ডবিধির ৪৯৪ ধারার বিধানের ব্যতিক্রম আর এই ব্যতিক্রমী ক্ষেত্রে স্ত্রীর দ্বিতীয় বিয়ে শাস্তিযোগ্য আপরাধ বলে গণ্য হবে না।
অন্যদিকে স্ত্রী যদি দ্বিতীয় বিয়ে করার সময় যাকে বিয়ে করছেন, তাঁর কাছে তার অতীতের সব কথা অর্থাৎ পূর্বের বিয়ের কথা গোপন করেন, তাহলে সেটিও দণ্ডবিধির ৪৯৫ ধারা অনুসারে একটি শাস্তি যোগ্য অপরাধ। এ অপরাধের সর্বোচ্চ শাস্তি ১০ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং আর্থিক জরিমানা।
২য় বিয়ের ক্ষেত্রে ইসলামের বিধানঃ
ইসলাম শান্তির ধর্ম এবং মুসলমানদের জন্য একটি পরিপূর্ণ জীবনবিধান। আমরা কিভাবে আমাদের জীবন অতিবাহিত করব তার সুস্পষ্ট বর্ণনা আছে পবিত্র কুরআনে ।
ইসলামী শরীয়ত অনুযায়ী একজন পুরুষের জন্য একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের সুযোগ রাখা হয়েছে। কিন্তু তার জন্য রয়েছে সমতার শর্ত ।সকল স্ত্রীর সমান অধিকার নিশ্চিত করন। ভরণপোষণ, আবাসন ও শয্যাযাপনের ক্ষেত্রে শতভাগ সমতাবিধান নিশ্চিত করা না গেলে একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণ ইসলামে বৈধ নয়। তবে হ্যাঁ, স্ত্রী বা নারীদের ক্ষেত্রে এই রকম কোন শর্ত রাখা হয়নি ।ইসলামে বলা হয়েছে যে স্ত্রী আগের স্বামীর সঙ্গে বিচ্ছেদের পর ইদ্দত শেষে অন্য স্বামী গ্রহণ করতে পারবেন।
পুরুষের ক্ষেত্রে একসঙ্গে একাধিক স্ত্রী গ্রহণের বৈধতা প্রসঙ্গে কোরআনের বক্তব্য এমন : ‘...তোমরা বিবাহ করবে নারীদের মধ্যে যাকে তোমার ভালো লাগে—দুই, তিন অথবা চার। আর যদি আশঙ্কা করো যে সুবিচার করতে পারবে না, তাহলে একজনকে (বিয়ে করো)...।’ (সুরা : নিসা, আয়াত : ৩)
করণীয় সেরা ৫ টি উপদেশ
২য় বিয়ে করার ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে এই পাঁচটি উপদেশ
১। প্রথম স্বামী বা স্ত্রীকে প্রচলিত আইন অনুযায়ী তালাক প্রদান
২। দেনমোহর পরিশোধ করা ।
৩।নতুন সম্পর্কে পা দেবার আগেই পূর্বের বিয়ের ব্যাপারে অবগত করা।
৪। নিজের সম্পর্কে জানা, অতীতের ভুলের ব্যাপারে সচেতন হওয়া এবং ৫ বাস্তবতাকে মেনে নেয়ার মত মানুষিক শক্তি সঞ্চয় ।
৫।নিজ মনে বিশ্বাস করা শেষ থেকেও নতুন করে শুরু করা যায়।
পরিশেষ
জীবনে আমাদের অনেক ঘটনারই সাক্ষী হতে হয়। তার ভেতর কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনাও থাকে।তবে ডিভোর্সের মত ঘটনাকে কেন্দ্র করে কখনই হতাশায় নিমজ্জিত হওয়া উচিত নয়।মনে রাখতে হবে ইচ্ছা শক্তি থাকলে সব হারিয়েও নতুন করে সুরু করা যায়।